নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা, ঈদ আনন্দযাত্রায় পথে পথে ভোগান্তি
প্রকাশিত : ০৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ, ২৮ জুন ২০২৩ বুধবার ৪৭ বার পঠিত
ঈদ আনন্দযাত্রায় সঙ্গী হয়েছে ভোগান্তি। চাহিদার তুলনায় রাস্তায় গাড়ি কম, বাড়তি ভাড়া আদায়, যানজট ও বৃষ্টির কারণে পথে পথে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ে বাস না পেয়ে ঢাকায়ই কয়েক ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়েছে অনেক যাত্রীর। এছাড়া দূরপাল্লার সড়কেও ছিল যানজট। বেশি ভোগান্তিতে পড়েন উত্তরাঞ্চলের যাত্রীরা।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রায় কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। একই অবস্থা হয় ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত সড়কেও। গাবতলী থেকে সাভারের সড়কেও থেমে থেমে গাড়ি চলেছে। স্বস্তি ছিল না ট্রেনের যাত্রীদেরও। ধূমকেতু, সুন্দরবন, নীলসাগরসহ বেশ কয়েকটি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের অনেক পড়ে ছেড়ে গেছে। এছাড়া প্রতিটি ট্রেনেই ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ যাত্রী ঠাসাঠাসি করে গন্তব্য গেছেন। তুলনামূলক কিছুটা স্বস্তি ছিল নৌপথে। লঞ্চগুলোয়ও উপচে পড়া যাত্রী ছিল। ভোগান্তি নিয়ে বাড়ি গেলেও সড়ক, ট্রেন ও নৌপথের যাত্রীদের মধ্যে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগের উচ্ছ্বাস ছিল। মঙ্গলবার সরেজমিন এসব চিত্র দেখা গেছে।
পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে সড়কপথে বাড়ি ফেরার জন্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যেসব যাত্রী সায়েদাবাদ কিংবা যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড় এসেছেন, তাদের দুই থেকে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। থেমে থেমে বৃষ্টি তাদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। একই ধরনের চিত্র ছিল গাবতলীতে। গাবতলী পশুর হাটের কারণে ঢাকায় গাড়ি ঢুকতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। ফিরতি বাস দেরিতে আসায় প্রায় সব কোম্পানির বাসের শিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়। টেকনিক্যাল থেকে গাবতলী পার হতেই এক ঘণ্টার বেশি লেগেছে।
বরিশালের মুলাদী যাবেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ শাফিউল হাসান। তিনি সকাল সাড়ে ৮টায় হানিফ পরিবহণের সায়েদাবাদ বাস কাউন্টারে আসেন। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত তার বাস আসেনি। শাফিউল হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গাড়ি কখন আসবে, তা কেউ বলছে না। শুধু বলছে, অপেক্ষা করেন আসবে। জানতে চাইলে হানিফ পরিবহণের সায়েদাবাদ কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা তারিকুল হাসান বলেন, বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে যে বাসগুলো যাত্রী নিয়ে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে, সেগুলো ফিরতে অনেক দেরি হচ্ছে। বিশেষ করে ধোলাইপাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসগুলো আটকে থাকছে।
গাবতলী টার্মিনালের পরিবহণ শ্রমিকরা জানান, চন্দ্রা, নবীনগর, হেমায়েতপুর ও আমিনবাজারের যানজটের কারণে ঢাকায় ফেরা বাস নির্ধারিত সময়ে আসতে পারছে না। এর সঙ্গে বাধ সেধেছে বৃষ্টি। এজন্য বেশির ভাগ বাস কোম্পানি শিডিউল রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে। গাবতলী থেকে ছেড়ে যাওয়া হানিফ পরিবহণের ম্যানেজার হুমায়ুন কবির জানান, কুষ্টিয়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলমুখী বাসগুলো ছাড়তে এক থেকে দুই ঘণ্টা দেরি হয়েছে। এজন্য তাদের বাড়তি গাড়ি দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে পাঠাচ্ছেন তারা।
এদিকে বাস না পেয়ে বিকল্প পথে গেছেন অনেক মানুষ। রাজধানীর আমিনবাজার থেকে ট্রাকে চড়েই বগুড়ার উদ্দেশে রওয়ানা দেন সিরাজুল ইসলাম। তার সঙ্গে ছিলেন আরও ১৩ জন। তারা সবাই সাভারের ম্যাগপাই গার্মেন্টে চাকরি করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকে চড়ে যাওয়ার বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, গার্মেন্টস ছুটির পরই তারা গাবতলী এসেছেন। কিন্তু বাস পাচ্ছেন না। যেসব বাস পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোয় ৮০০-৯০০ টাকা ভাড়া চাচ্ছে। অথচ অন্য সময়ের ভাড়া ৫৫০ টাকা। তিনি বলেন, হাজার হাজার মানুষ আছে; কিন্তু বাস কই? তার ওপর বাড়তি ভাড়া। তাই ট্রাকে জনপ্রতি ৪৫০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে বাড়ি যাচ্ছি। কষ্ট হলেও স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে পারবেন, তাই খুশি লাগছে বলেও জানান তিনি।
পরিবহণসংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদুল ফিতরে স্বস্তিতেই যাত্রীরা বাড়ি গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার ঈদুল আজহায় সড়ক-মহসাড়কে ভিন্নচিত্র। মঙ্গলবার গার্মেন্টস, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি অফিস ছুটি হয়েছে। ছুটির পরই সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও নরসিংদীতে একই সঙ্গে হাজার হাজার শ্রমিক বাড়ির উদ্দেশে যেতে রাস্তায় নেমেছে। পাশাপাশি সড়কে বিশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে অনেক বাস যাত্রী তুলেছে। এসব কারণে ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথগুলোয় যানজট তৈরি হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতুতে সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকবার টোল আদায় বন্ধ ছিল। মঙ্গলবার কয়েক দফা বৃষ্টিও হয়। এসব কারণে সড়কপথে যানজট তৈরি হয়। গাড়ির সংকট পুঁজি করে বিভিন্ন রুটে ১০০-৪০০ টাকা বাড়তি ভাড়াও আদায় করা হয়। বাড়তি ভাড়া এড়াতে ট্রাক, পিকআপে চড়েও বিভিন্ন জেলায় গেছেন ঘরমুখো মানুষ।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের তথ্য উঠে আসে। মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, এবারের ঈদে যানজট ও জনজট নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা দেখা গেছে। একই সঙ্গে ঈদযাত্রায় বিভিন্ন রুটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চলছে। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের পথে বিভিন্ন রুটে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম থেকে ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীসহ উত্তরবঙ্গের পথে যাত্রীপ্রতি দিগুণ ভাড়া আদায় করা হয়। তিনি এসব বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকায় যানজট: টাঙ্গাইল থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, সেতুর ওপরে একাধিক দুর্ঘটনা এবং গাড়ি বিকল হওয়ায় ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহসড়কে আট কিলোমিটার এলাকায় থেমে থেমে যানজট হয়। মঙ্গলবার ভোরে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দুবার দুর্ঘটনা এবং একবার গাড়ি বিকল হয়। এতে কয়েকবার টোল আদায় বন্ধ ছিল। ওই ঘটনায় সেখানে যানজট তৈরি হয়।
সিরাজগঞ্জের এসআই পরিবহণের চালক রাকিব হোসেন বলেন, মহাসড়কের কামাক্ষা মোড় থেকে সেতু পর্যন্ত আসতে চার ঘণ্টার বেশি লেগেছে। যানজটে আটকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানার এসআই আল আমিন বলেন, যানজট নিয়ন্ত্রণে আমরা মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করছি। সেতুর ধারণক্ষমতার চেয়ে সড়কে গাড়ির সংখ্যা বেশি। এছাড়াও সেতুর ওপরে দুর্ঘটনা এবং গাড়ি বিকল হওয়ায় ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল করছে।
চন্দ্রায় ৫ কিলোমিটার যানজট: কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসাবে পরিচিত গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রায় প্রায় ৫ কিলোমিটার থেমে থেমে যানজট ছিল। এছাড়া কারখানাগুলো ছুটি হওয়ায় শ্রমিকরা একসঙ্গে বাড়ি যাওয়ার কারণে এ যানজটের তীব্রতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এতে ঈদে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যাত্রীদের চাপ বেশি হওয়ায় ভাড়া বেশি আদায় করেছে বলেও অভিযোগ যাত্রীদের।
নাওজোড় হাইওয়ে থানার ওসি আতিকুর রহমান বলেন, একসঙ্গে যাত্রী এবং যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সড়কে থেমে থেমে ধীরগতিতে গাড়ি চলছে। তবে এটা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তাছাড়া সড়কে ঈদে ঘরমুখো মানুষের নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে।
ট্রেনেও দুর্ভোগ: ঈদযাত্রার চতুর্থ দিনে মঙ্গলবার বেশির ভাগ ট্রেন নির্ধারিত সময়ের পর ছেড়ে যায়। প্রতিটি ট্রেনেই যাত্রীদের ভিড় ছিল। এমনকি বাদুড়ঝোলা হয়েও অনেকে গন্তব্যে গেছেন। রাজশাহীগামী যাত্রী কামরুজ্জামান বলেন, ট্রেনের আগাম টিকিট পাইনি। গ্রামে যেতে হবে, তাই ট্রেনে উঠে পড়েছি।
জানা যায়, আন্তঃনগর ট্রেন ধূমকেতু এক্সপ্রেস প্রায় দুই ঘণ্টা দেরিতে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। নীলসাগর এক্সপ্রেস সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা ৮টা ১৭ মিনিটে ছেড়ে যায়। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস সকাল ৮টা ১৫ মিনিট ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি ছাড়ে ৯টা ১০ মিনিটে। এছাড়া দুপুরের পর থেকে ১৭টি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের পর কমলাপুর স্টেশন ত্যাগ করে।
জানতে চাইলে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির জানান, কমলাপুর স্টেশনে বিনা টিকিটি যাত্রী রোধ সম্ভব হলেও সামনের কোনো স্টেশনেই তা করা সম্ভব হয়নি। মানুষের স্রোত সামলানো সম্ভব হয়নি। প্রতিটি ট্রেনেই অতিরিক্ত যাত্রী। ফলে ট্রেনের গতি কমিয়ে চালাতে হচ্ছে। যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হয়েছে।
kushtiatime24.com'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।